সিলেট প্রতিনিধিঃ সিলেট এমসি কলেজ ক্যাম্পাসে কলেজ ছাত্রী খাদিজা আক্তার নার্গিসকে নৃশংসভাবে কুপিয়ে হত্যার চেষ্টাকারী ছাত্রলীগ নেতা বদরুল আলমকে গ্রেপ্তার, শাস্তির দাবিতে বিক্ষোভ ও মানববন্ধন করেছেন সিলেটের সর্বস্তরের শিক্ষার্থীরা।
সোমবার সন্ত্রাসী বদরুলের চাপাতির কোপে মারাত্মক আহত হন কলেজ ছাত্রী খাদিজা আক্তার নার্গিস। আহত নার্গিস বর্তমানে ঢাকার স্কয়ার হাসপাতালে জীবন-মৃত্যুর সন্ধিক্ষণে। মঙ্গলবার বিকালে অস্ত্রোপচার শেষে তাকে ৭২ ঘণ্টার নিবিড় পর্যবেক্ষণে রাখা হয়েছে।
এ ঘটনার প্রতিবাদে মঙ্গলবার সকালে টিলাগড় এমসি কলেজের সামনের সড়কে ও সিলেট সরকারি মহিলা কলেজে মানববন্ধন অংশ নেয় সাধারণ শিক্ষার্থীরা। এ সময় শিক্ষার্থীদের মানববন্ধনে সংহতি প্রকাশ করে যোগ দেয় ছাত্রলীগও।
মানববন্ধন থেকে শিক্ষার্থীরা নার্গিসের ওপর নৃশংস হামলাকারী বদরুল আলমের সর্বোচ্চ শাস্তি দাবি করেন। মানববন্ধন চলাকালে সিলেট-তামাবিল মহাসড়কে যানবাহন চলাচল বন্ধ ছিল।
উল্লেখ্য, সোমবার এমসি কলেজ কেন্দ্রে ডিগ্রি ২য়
বর্ষের পরীক্ষা দিয়ে বের হওয়ার পর বদরুলের চাপাতির কোপে আহত হয় নার্গিস।
পুলিশ জানায়, প্রেম প্রত্যাখ্যাত হওয়া শাহজালাল বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র বদরুল আলম এলোপাতাড়ি কুপিয়ে খাদিজাকে আহত করে। পরে শিক্ষার্থীরা ধরে তাকে গণপিটুনি দেয়। শিক্ষার্থীদের কবল থেকে পুলিশ বদরুলকে উদ্ধার করে হাসপাতালে ভর্তি করে।
অন্যদিকে, নার্গিসের অবস্থার অবনতি হওয়ায় রাতেই তাকে সিলেট থেকে উন্নত চিকিৎসার জন্য ঢাকায় নেয়া হয়। বর্তমানে তাকে ঢাকা স্কয়ার হাসপাতালে নিবিড় পর্যবেক্ষণে (আইসিইউ) রাখা হয়েছে।
পুলিশ সূত্র আরও জানায়, সিলেট সদর উপজেলার মোগলগাঁও ইউনিয়নের হাউসা গ্রামের মাসুক মিয়ার মেয়ে খাদিজা আক্তার নার্গিস। শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের (শাবি) অর্থনীতি বিভাগের শেষ বর্ষের ছাত্র ও শাবি ছাত্রলীগের সহসম্পাদক বদরুল আলম এক সময় আহত ছাত্রীর বাড়িতে লজিং থাকত।
সিলেট মহানগরীর শাহপরাণ থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) শাহজালাল মুন্সি বলেন, ছাত্রী আহতের ঘটনায় শিক্ষার্থীরা মানববন্ধন ও বিক্ষোভ করে বখাটে বদরুলের সর্বোচ্চ শাস্তি দাবি করেছে। তারা চান এ ধরনের নৃশংসতার সর্বোচ্চ শাস্তি হোক। ছাত্রীর ওপর হামলার ঘটনায় এখনও মামলা হয়নি। হামলাকারী বদরুলকে ওসমানী মেডিকেল কলেজে চিকিৎসাধীন রাখা হয়েছে। সুস্থ হওয়ার পর তাকে আদালতে সোপর্দ করা হবে।
এদিকে এ ঘটনায় জড়িত শাবি ছাত্রলীগের সহ-সম্পাদক বদরুল আলমের শাস্তির দাবি জানিয়েছেন সিলেটের সুশীল সমাজ, রাজনীতিবিদ থেকে শুরু করে সবাই। তারা বলেন, এ ধরনের ন্যক্কারজনক ঘটনা যেন আর দেখতে না হয়। হযরত শাহজালাল (রহ.) পূণ্যভূমি সিলেটকে যে বা যারা কলুষিত করার চেষ্টা করছে তাদের কঠোর হাতে দমন করতে হবে। এ ক্ষেত্রে কারো রাজনৈতিক পরিচয় যেন মুখ্য হয়ে না ওঠে।
সিলেট মহানগর আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক আসাদ উদ্দিন আহমদ বলেন, এ ধরনের ন্যক্কারজনক হামলা মেনে নেয়া যায় না। এটা অবশ্যই অমানবিক। ছাত্রলীগের কেন্দ্রীয় নেতাদের এ ব্যাপারে কঠোর হতে হবে। টেনে ধরতে হবে বেপরোয়া কর্মীদের লাগাম।
সুশাসনের জন্য নাগরিক (সুজন) সিলেটের সভাপতি ফারুক মাহমুদ চৌধুরী বলেন, এ হামলা ন্যক্কারজনক। সামাজিক ও পারিবারিক অবক্ষয়ের কারণে এটা ঘটেছে। ছাত্রলীগের নামে বেপরোয়া চলাচলের কারণে আজ একটি মেয়ে হাসপাতালে মৃত্যুর সঙ্গে লড়ছে। হামলাকারীর রাজনৈতিক পরিচয় না খুঁজে তার অপরাধ বিবেচনায় এনে সর্বোচ্চ শাস্তি প্রদান করা উচিত।
সিলেট জেলা বারের সাবেক সভাপতি এএফএম রুহুল আনাম চৌধুরী মিন্টু বলেন, এ ধরনের হামলার বিচার না হলে হামলার পুনরাবৃত্তি ঘটতে পারে। সোমবার রাতে হাসপাতালে মেয়েটিকে দেখতে গেলে ডাক্তারদের সঙ্গে কথা বলে জানতে পারেন, মেয়েটিকে এমনভাবে কোপানো হয়েছে আল্লাহ তাকে বাঁচিয়ে রাখলেও স্বাভাবিক জীবন-যাপন করতে পারবে কিনা সন্দেহ। হামলাকারীর সর্বোচ্চ শাস্তি হওয়া উচিত।
ব্যবসায়ী আমিনুল ইসলাম বলেন, প্রেম প্রত্যাখ্যান করলে জীবন নষ্ট করে দেয়ার সংস্কৃতি সিনেমায় দেখা যায়, বাস্তবতা ভিন্ন। এ হামলার ঘটনা সামাজিক অবক্ষয়ের উৎকৃষ্ট উদাহরণ।
অবস্থা সংকটাপন্ন
সর্বশেষ খবরে জানা গেছে, খাদিজা বেগম নার্গিসের অবস্থা সংকটাপন্ন। মঙ্গলবার বিকালে অস্ত্রোপচার শেষে তাকে রাজধানীর স্কয়ার হাসপাতালে ৭২ ঘণ্টার নিবিড় পর্যবেক্ষণে রাখা হয়েছে। চিকিৎসকরা বলেছেন, খাদিজার শারীরিক অবস্থা নিয়ে এখন বলার মতো কিছু নেই। ৭২ ঘণ্টা পার হলে তবেই বলা যাবে।
এর আগে মঙ্গলবার বেলা দেড়টার দিকে স্কয়ার হাসপাতালের দায়িত্বরত এক চিকিৎসক জানান, ছাত্রীর অবস্থা আশঙ্কাজনক। তার সারা শরীরে কোপের দাগ। মাথার আঘাত গুরুতর। তার শরীরে অস্ত্রোপচার করা হচ্ছে।
হত্যাচেষ্টার অভিযোগে মামলা
সিলেটে কলেজছাত্রী খাদিজা আক্তার নার্গিসকে কুপিয়ে জখম করার ঘটনায় শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ?্যালয়ের (শাবি) ছাত্রলীগ নেতা বদরুল আলমের বিরুদ্ধে মামলা হয়েছে।
মঙ্গলবার দুপুর ২টার দিকে ওই ছাত্রীর চাচা আব্দুল কুদ্দুস হত্যাচেষ্টার অভিযোগ এনে শাহপরাণ থানার মামলাটি করেন।
শাহপরাণ থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) শাহজালাল মুন্সি বলেন, ‘মামলায় বদরুল ইসলামকে একমাত্র আসামি করা হয়েছে। ঘটনার পর স্থানীয়দের মারধরে বদরুল কিছুটা আহত হওয়ায় তাকে সিলেট ওসমানী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে ভর্তি করা হয়েছে।’
শাবি ছাত্র বদরুল বহিষ্কার
সিলেট সরকারি মহিলা কলেজের ছাত্রী খাদিজাকে কোপানোর ঘটনায় বদরুল ইসলামকে বহিষ্কার করেছে শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ।
মঙ্গলবার দুপুরে বিশ্ববিদ্যালয় থেকে তাকে সাময়িক বহিষ্কার করা হয়েছে বলে জানান উপাচার্য আমিনুল হক ভূইয়া।
তিনি বলেন, প্রক্টরিয়াল কমিটির সভার সিদ্ধান্ত অনুযায়ী তাকে বিশ্ববিদ্যালয় থেকে সাময়িক বরখাস্ত করা হয়েছে।
বদরুল বিশ্ববিদ্যালয়ের ২০০৮-০৯ শিক্ষাবর্ষের অর্থনীতি বিভাগের অনিয়মিত ছাত্র বলেও জানান উপাচার্য।
আমাদের কেউ না: ছাত্রলীগ
সিলেট সরকারি মহিলা কলেজের ছাত্রী খাদিজা বেগম নার্গিসের ওপর হামলাকারী বদরুল আলমের সঙ্গে ছাত্রলীগের কোনো সম্পর্ক নেই বলে দাবি করেছে সংগঠনটি। তারা বলছে, এটি একান্তই বদরুল আলমের ব্যক্তিগত নৃশংসতা।
মঙ্গলবার ছাত্রলীগের দপ্তর সম্পাদক দেলোয়ার হোসেন স্বাক্ষরিত এক সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে এ দাবি করা হয়।
ছাত্রলীগের বিজ্ঞপ্তিতে দাবি করা হয়, বদরুল আলমের সঙ্গে শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্রলীগের বর্তমানে কোনো ধরনের সম্পর্ক নেই। তিনি শিক্ষক হিসেবে সুনামগঞ্জের ছাতক উপজেলার আলহাজ আয়াজুর রহমান উচ্চবিদ্যালয়ে কর্মরত রয়েছেন। সাংগঠনিক নিয়মে, কর্মক্ষেত্রে যোগদানের সঙ্গে সঙ্গেই তার সদস্যপদ বাতিল বলে গণ্য হয়।
বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়, সিলেট এম সি কলেজে সংঘটিত সন্ত্রাসী কর্মকা- একান্তই বদরুল আলমের ব্যক্তিগত নৃশংসতা। তার ব্যক্তিগত অপকর্মের দায়ভার কোনোভাবেই বাংলাদেশ ছাত্রলীগ নিতে পারে না। যেহেতু সে বর্তমানে ছাত্রলীগের সঙ্গে সম্পর্কহীন এবং অন্য একটি পেশায় কর্মরত, তাই গণমাধ্যমের সাংবাদিক বন্ধুদের প্রতি আহ্বান তারা যেন সন্ত্রাসী বদরুল আলমের ব্যক্তিগত অপকর্মের সঙ্গে ঐতিহ্যবাহী ছাত্রসংগঠন বাংলাদেশ ছাত্রলীগকে না জড়ান বা ছাত্রলীগের নাম ব্যবহার না করেন।
বিজ্ঞপ্তিতে ছাত্রীর ওপর হামলার ঘটনায় ছাত্রলীগ ব্যথিত উল্লেখ করে এ ঘটনার নিন্দা জানানো হয়। বদরুল আলমকে দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি দিতে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী ও প্রশাসনের প্রতি আহ্বান জানানো হয়।